লিট বাংলা ডট টেক, প্রযুক্তির হাতেখড়ি হোক বাংলাতেই।

হ্যাকিং / সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক বাংলা প্রযুক্তির ব্লগ

ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাকারদের সাইবার যুদ্ধ। বর্তমান অবস্থা, সক্ষমতা এবং সম্ভাব্য ফলাফল।


মার্কিনিদের গুপ্তহত্যার শিকার আল-কুদস ফোর্সের প্রধান ও বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় কঠিন প্রতিশোধ নেয়ার হুঙ্কার দিয়েছে ইরান। উত্তেজনার মাঝেই শুরু হয়ে গেছে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার যুদ্ধ।  

"ইরান সাইবার সিকিউরিটি গ্রুপ হ্যাকার্স" ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিটরি লাইব্রেরি প্রোগ্রামের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। ওয়াশিংটন ডিপার্টমেন্টের আরেকটি সরকারি ওয়েবসাইট ও ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে। 

স্বাভাবিক ভাবেই হ্যাকাররা ওয়েবসাইটের সকল তথ্য মুছে দিয়ে  মার্কিন হামলায় নিহত ইরানের শীর্ষ সেনা কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি হত্যার প্রতিশোধের শপথ করে এক বার্তা প্রকাশ করেছে। রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পকে ব্যাঙ্গ করা একটি ছবিও। 
এছাড়াও ইরানের নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনী ও ইরানের পতাকার ছবি ওয়েবসাইটের ডিসপ্লেতে আপলোড করা হয়।

ইরানিয়ান হ্যাকার গ্রুপ পরিচিতিঃ 
সাইবার জগতে ইরানিয়ান হ্যাকারদের বেশ পরিচিতি রয়েছে। ২০১০ সাল থেকেই বেশ কিছু ইরানিয়ান হ্যাকার গ্রুপ হ্যাকিং কমিউনিটিতে দাপটের সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
এর মধ্যে ইরানিয়ান সাইবার আর্মি, পার্সিয়ান হ্যাকার গ্রুপ, শিল্ড ইরান, আসিয়ানে ডিজিটাল সিকিউরিটি টিম অন্যতম। নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া ইরানিয়ান সাইবার আর্মির সদস্যদের সাথে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের হ্যাকারদের সাথে বেশ সখ্যতা ছিলো। তবে সম্প্রতি গত তিন বছর সময়ে ফসফরাস, যার আরেক নাম ‘এপিটি ৩৫’ হ্যাকার টিমটি আন্তর্জাতিক ভাবে ইরানের হয়ে হ্যাকিং কার্যক্রম পরিচালিত করে আসছে। 


আমেরিকান হ্যাকার গ্রুপ পরিচিতিঃ 
বলা হয়ে থাকে ইন্টারনেটের দুই তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই আছে। তাই সরকারি ভাবে আমেরিকা ইন্টারনেট জগতে অনেক শক্তিশালী। সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দিয়েছেন যে প্রিজম কর্মসূচির আওতায় ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট, ইয়াহু, ইউটিউব এবং অ্যাপলসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়েই তাদের সার্ভারে সরাসরি প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসআই) ও ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। তাই রাষ্ট্রীয় ভাবে আমেরিকা হ্যাকিং দিকেও অনেক শক্তিশালী, তবুও কিছু হ্যাকার গ্রুপ স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ডিসি লিকস, হংকার ইউনিয়ন, এনন কোড, লাজারুস অন্যতম।

বর্তমান সাইবার যুদ্ধের অবস্থাঃ 
ইতিমধ্যেই ইরান সাইবার সিকিউরিটি গ্রুপ হ্যাকার্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিটরি লাইব্রেরি প্রোগ্রামের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। ওয়েবসাইটটি এখনো অচল অবস্থায় আছে। লিংকঃ fdlp.gov
মোসলেম নামক একটি হ্যাকার দল ওয়াশিংটন ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ৬ টি পৃথক সরকারি দপ্তরে হামলা চালিয়েছে। শিল্ড ইরান নামের একটি হ্যাকার দল ও এই সাইবার যুদ্ধে অংশ নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। সেই সাথে ব্যাংক অফ আমেরিকার একটি ব্লগ পোর্টাল সহ আরো কিছু ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে শিল্ড ইরান।
উল্লেখ্য, এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাকারদের থেকে পাল্টা কোন আক্রমনের খবর পাওয়া যায় নি।

ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার যুদ্ধের সূচনা এবং ইতিহাসঃ 
ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার সাইবার যুদ্ধে একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়েছিলো। ২০১০ এর জুন মাসে ইরানের নিউক্লিয়ার গবেষণাগারে সাইবার এট্যাক চালানো হয়। ভাইরাসের নাম ছিলো 'স্টাক্সনেট'। এট্যাকটটি চালানো হয়েছিলো আমেরিকা এবং ইসারাইল এর যৌথ উদ্যোগে। সেই সময়ে স্টাক্সনেট প্রায় ১০০০ নিউক্লিয়ার সেন্ট্রিফিউজ নষ্ট করে দেয়। আরেকটি রিপোর্টের মতে, ইরানের প্রায় ৬০ হাজার কম্পিউটার এই স্টাক্সনেট ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। 
২০১২ সালে একটি রিপোর্টে বলা হয় ইরানের গভর্নমেন্ট দ্বারা আমেরিকা-ইসরাইল এর ব্যাংক এ সাইবার এট্যাক চালানো হয়। আর এটাকেই বলা হয় ইরান আমেরিকার সাইবার যুদ্ধের সূচনা।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুন মাসে ইরান এক হামলায় ২৪০ মিলিয়ন ডলারের আমেরিকান ড্রোন ভুপাতিত করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ইরানিয়ান মিসাইল নিয়ন্ত্রণ করার সামরিক কম্পিউটার সিস্টেমে সাইবার আক্রমন পরিচালনা করে।

ইরানিয়ান হ্যাকারদের সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপঃ 
আল-কুদস ফোর্সের প্রধান ও বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে ইরানিয়ান হ্যাকারদের কিছু কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়েছিলো। ২০১৯ সালের অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩০ দিনে ইরানিয়ান হ্যাকার গ্রুপ ফসফরাস দুই হাজার সাতশত বার বিভিন্ন ইমেইল অ্যাকাউন্টের পরিচয় জানার চেষ্টা চালিয়েছে। এরপর দলটি ২৪১টি ইমেইল অ্যাকাউন্টের উপর আক্রমণ চালায়।
“এসব অ্যাকাউন্টধারীর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা সংশ্লিষ্ট লোকজন, সাবেক ও কর্মরত মার্কিন সরকারী কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে কাজ করেন এমন সাংবাদিক এবং প্রভাবশালী প্রবাসী ইরানী ব্যক্তি”
বলা যেতেই পারে ইরানিয়ান হ্যাকারদের পরবর্তী পদক্ষেপ থাকবে মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরেই।

যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাকারদের সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপঃ 
রাশিয়া এবং ইরানিয়ান হ্যাকারদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলেও বর্তমান যুদ্ধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক একটি ইস্যু হওয়ার কারনে ইরানের সাথে রাশিয়ান এবং চাইনিজ হ্যাকাররা যোগ দিতে পারে। রাষ্ট্রীয় ভাবে নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় জড়িত থাকার দরুণ সরকারি কিংবা বেসরকারি ভাবে আমেরিকার পক্ষ থেকে পাল্টা সাইবার আক্রমন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক ক্ষীণ। 

সম্ভাব্য ফলাফলঃ 
যেহেতু সাইবার যুদ্ধটা শুরু হয়েছে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় তাই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে ইরানকে বিষয়টা নিয়ে সমাধান করতে পারে তার উপর সাইবার যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করছে। তবে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে সাইবার যুদ্ধ শুরু করা ইরান চলমান সাইবার আক্রমনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে থাকবে।

নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের হ্যাকারদের সাইবার যুদ্ধের ইতিহাসঃ 
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর সময় ভারতীয় সীমান্ত-রক্ষীদের গুলিতে বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুনের মৃত্যুর ঘটনায় ২০১১ সালে বাংলাদেশের হ্যাকাররা ভারতের বিপক্ষে সাইবার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। উক্ত সাইবার যুদ্ধে ভারতীয় ৩০ হাজারেরও অধিক ওয়েবসাইট আক্রমনের শিকার হয়েছিলো।